• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

হুমকির মুখে সুন্দরবনের বৈচিত্র্য

  • ''
  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০২৪

খবর প্রতিবেদক, বাগেরহাট:

বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাহারি গাছপালা, বন্য পশু-পাখি ও জীবজন্তু ঘেরা এই বনভূমি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের আধার নয়, বরং এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দেশের হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা। কিন্তু নানা কারণে বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে ২২ বছরে ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত শনিবার বনের ভেতরে আগুন লেখেছে, যা এখনো জ্বলছে। এতে সুন্দরবন রক্ষায় এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা এই বনভূমির নিরাপত্তা জোরদার করতে এর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন।

গত ২২ বছরে ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের আগুন নেভাতে দুই দিনের বেশি সময় লেগেছিলো। সর্বশেষ, শনিবার (৪ মে) দুপুরে বনে লাগা আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যদের পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন বন বিভাগের সদস্য ও স্থানীয়রাও। গতকাল রোববার দুপুর ১২টা নাগাদ এতে যোগ দেয় বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারও। ওপর থেকে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভাতে চেষ্টা চলছে। সকাল থেকে নৌ, বিমান, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও বনরক্ষীদের সব ধরনের প্রচেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করেছে বন বিভাগ।

এদিকে, এখন পর্যন্ত বন কতটুকু পুড়েছে, তা জানাতে পারেনি বন বিভাগ। তবে এর আগে, গত ২৪ বারের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ একরের বনজ সম্পদ (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতা-গুল্ম) পুড়ে যায় বলে জানা গেছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দুবার; ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতারখাল এলাকায় দুবার; ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমুরবুনিয়া, খুড়াবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার; ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার; ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার; ২০১১ সালে নাংলীতে দুবার; ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার; ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার; ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার; চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় এবং এরপর ২০২১ সালের ৩ মে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২৪ বারের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ একরের বনজ সম্পদ (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতা-গুল্ম) পুড়ে যায়।

সুন্দরবনে বারবার অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে এমনি এমনি আগুন লাগতে পারে না। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। হয়তো মাছ শিকারি, মধু সংগ্রাহকদের বিড়ি-সিগারেট থেকে আগুন লাগতে পারে। বিভিন্ন সময়ে আগুন লাগার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি। এতে সুন্দরবনের আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনা বিভাগের উপপরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শোনার পর বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা সেখানে ছুটে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে। ৩টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে। নৌবাহিনী, বন বিভাগ, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন সকলে আগুন নেভাতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আগুন লাগার জায়গাটিতে শুকনো পাতার অনেক পুরু স্তূপ রয়েছে। এখন পর্যন্ত ছোট গাছ, লতাপাতা পুড়েছে দেখা যাচ্ছে।

এর আগে, ২৪ দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের গঠিত তদন্ত দল নাশকতা, অসচেতনতা, অবহেলায় ফেলে দেওয়া বিড়ি বা সিগারেটের আগুনকে দায়ী করেছে। তদন্ত কমিটিগুলো বনকে সুরক্ষা দিতে করেছে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ। এরমধ্যে অন্যতম হলো বন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, বন-সংলগ্ন মরে যাওয়া নদ-নদী খনন এবং সীমান্ত এলাকায় বেড়া ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ। তবে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন সব সময়ই উপেক্ষিত থেকে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বন বিভাগ, স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীরা বনজ সম্পদ সুরক্ষিত করতে নিরাপত্তা পদ্ধতির পরিবর্তনে জোর দাবি জানিয়ে আসছেন।

এদিকে, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. নুরুল করীম জানান, রোববার সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজে যোগ দিয়েছে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকসহ প্রায় ৫ শতাধিক সদস্য। এছাড়া সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করছেন।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেবকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা মো: রবিউল ইসলাম ও ঝিউধারা স্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান।

কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে যদি অগ্নিকাণ্ডের কারণ ‘মানবসৃষ্ট’ বলে উঠে আসে, তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন এই বন কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads